মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৭ অপরাহ্ন
লোকমান হাকিম : দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সূচনা করলো মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর। নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের কয়লাবাহী পানামার জাহাজ ‘অউসো মারো’ ভিড়েছে এ বন্দরে। এর আগে এত বড় জাহাজ দেশের কোনো বন্দরে ভিড়েনি। বৃহৎ এই জাহাজটি জেটিতে ভেড়াতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশি পাইলটরা।
এদিন জাহাজটি জেটিতে ভিড়লে উচ্ছ¡সিত ক্রুদের করতালি দিয়ে অভিবাদন জানান স্থানীয় সংসদ, বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যান্যরা।
এ নিয়ে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্য ও বন্দর ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সক্ষমতার রেকর্ড গড়লো বাংলাদেশ। এ বন্দর দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে ১১৩টি জাহাজ।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন আতাউল হাকিম বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া থেকে ৮০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে গত ১৩ এপ্রিল যাত্রা করার পর সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাহাজটি মাতারবাড়ি উপক‚লে নোঙর করে। এরপর মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে জাহাজটি জেটিতে ভেড়ানো হয়। আর এর মাধ্যমে কয়লাবাহী জাহাজের যাত্রা শুরু হলো মাতারবাড়িতে।’
আতাউল হাকিম বলেন, ‘২২৯ মিটার দীর্ঘ ও ১২ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের কোনো জাহাজ এর আগে দেশে ভেড়েনি। সমুদ্র থেকে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৫০ মিটার চওড়া কৃত্রিম চ্যানেলের মধ্য দিয়ে জাহাজটি জেটিতে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের জন্য এটা মাইলফলক।’
এই গভীর সমুদ্র বন্দরের পাশেই ১২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল খনন করা হয়েছে। এই চ্যানেলের পাশেই গড়ে উঠবে গভীর সমুদ্রবন্দরের জেটি। আগামী জুনে সমুদ্রবন্দরের জেটি নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গেল ২৬ মার্চ আমদানি করা কয়লা নিয়ে জাহাজটি মাতারবাড়িতে আসার কথা ছিল। কিন্তু জটিলতার কারণে সেটি একমাস পেছানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার বিকেলে জাহাজটি জেটিতে ভিড়েছে।’
আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জাহাজটি সাড়ে ১২ মিটার ভেতরে প্রবেশ করা হয়েছে। এই কার্যক্রমে জাপান, ইন্দোনেশিয়ার পাশাপাশি অনেকগুলো দেশসহ সিএন্ডএনএফ, শিপিং এজেন্ট, সিপিজিসিএল জড়িত।’
গভীর সমুদ্রবন্দর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি এই বন্দর যদি না হতো বাইরে নোঙর করলে মালামাল ও কয়লা খালাস করতে একমাস সময় লাগতো। এখন ২/৩ দিনের মধ্যে লোড-আনলোড করতে করতে পারবে। এছাড়া বন্দর নেপাল, ভারত, ভুটানও এই বন্দর কাজে লাগাতে পারবে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।’
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) অধীনে জাপানের তিনটি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়াম বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি স্টিম টারবাইন, সার্কুলেটিং কুলিং ওয়াটার স্টেশন স্থাপন, ২৭৫ মিটার উচ্চতার চিমনি ও পানি শোধন ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি টাউনশিপ নির্মাণ, গ্রাম বিদ্যুতায়ন এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন কাজের আওতায় চকরিয়া-মাতারবাড়ি ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ ও ১৩২/৩৩ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অ্যাশ ডিসপোজাল এরিয়া এবং বাফার জোন নির্মাণ করা হবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে দুটো অংশ রয়েছে। একটি অংশ হলো বন্দর নির্মাণ এবং অপর অংশটি সড়ক ও জনপথের আওতাধীন রাস্তা নির্মাণ। ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার প্রকল্পে বন্দর অংশে রয়েছে ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং সড়ক ও জনপথ অংশে রয়েছে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় ৩০০ মিটার দীর্ঘ একটি মাল্টিপারপাস জেটি এবং ৪৬০ মিটার দীর্ঘ একটি কনটেইনার জেটি নির্মিত হবে। চ্যানেলের (জাহাজ চলাচলের পথ) চওড়া ৩৫০ মিটার এবং গভীরতা ১৬ মিটার। জেটি নির্মাণ কাজ শেষ করতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। সে বছর ১১ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন্দর।
সম্প্রতি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এসময় তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর দৃশ্যমান হয়েছে। ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার জেটি, ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাজ জেটি, কন্টেইনার ইয়ার্ডসহ বন্দরের অন্যান্য কাজ শুরু করার জন্য টেন্ডার আহŸান করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে সর্বোচ্চ ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ ভেড়ার সুযোগ আছে। অন্যদিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে সর্বোচ্চ এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়ার সক্ষমতা রয়েছে।
২০১৫ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লা বিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরবর্তী সময়ে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের চওড়া ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কোনো চালান সরাসরি ইউরোপে যায় না। প্রথমে কার্গো কন্টেইনারগুলো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো বন্দরে যায়, এবং সেখানে ইউরোপে যাওয়ার মতো কোনো মাদার ভেসেলের জন্য অপেক্ষা করে। এর ফলে সময় ও খরচ অনেক বেড়ে যায়। ২০২৬-এর জানুয়ারি মাসের মধ্যে সমুদ্রবন্দরের শেষ কাজ হলে বড় আকারের ফিডার ভেসেল সরাসরি বাংলাদেশে আসতে পারবে এবং সময় ও খরচ বাচাবে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন এবং একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে মাতারবাড়ি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply